হ্যাকার শব্দটি শুনলে কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের সামনে যে চিত্র ভেসে ওঠে সেটা হচ্ছে, একদল মানুষ যারা সবসময় অন্যের কম্পিউটারে কি আছে খোজ করছে, সুযোগ পেলে অনলাইন একাউন্ট থেকে টাকা চুরি করছে, ব্যক্তি তথ্য সংগ্রহ করছে, ভাইরাসের আক্রমন ঘটাচ্ছে। এতসব অভিযোগের পর হ্যাকারকে পছন্দ করার কোনই কারন নেই।
যদি প্রশ্ন করা হয় উইকিলিকস পছন্দ করেন কি-না তার উত্তর ততটা সহজ হবে না। সবদেশের সরকার সরকার এর বিপক্ষে কিন্তু সাধারন মানুষ তাদের পক্ষে। তারা সত্য প্রকাশ করেছে। পাকিস্তান সরকার মুখে আমেরিকার আক্রমনে হত্যার প্রতিবাদ জানাচ্ছে আবার চিঠিপত্রে আক্রমন করতে বলছে, কিংবা মার্কিন সেনা ঠান্ডা মাথায় সাংবাদিক হত্যা করে সেটা অস্বিকার করেছে অথচ তাদের সাইটে ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে সেই ঘটনার। এমনকি গত তত্তাবধায়ক সরকারের সময় গোপনিয় সব চিঠি প্রকাশ করেছে তারা। এসব ঘটনা নেতাদের পছন্দ হওয়ার কথা না। সাধারন মানুষ মনে করে এসব জানা তাদের অধিকার। তাদের ট্যাক্সের টাকায় দেশ চলে, তারাই ঠিক করে কে সরকারে যাবে। কাজেই উইকিলিকস ঠিক কাজ করেছে। এর পেছনের ব্যক্তি জুলিয়ান আসাঞ্জকে অপরাধী বানানোর সব চেষ্টা করে যাচ্ছে পশ্চিমা সরকারগুলি, অন্যদিকে তার পক্ষে প্রতিবাদ করছে সাধারন মানুষ।
জুলিয়ান আসাঞ্জ কি হ্যাকার ?
সরলভাবে, হ্যা। হ্যাকিং শব্দটি প্রচলিত ইন্টারনেট কিংবা কম্পিউটার ব্যবহার শুরুর অনেক আগে থেকে। বাংলায় হ্যাকিং এর অর্থ ধরতে পারেন অনধিকার প্রবেশ। চাবি ছাড়া কারো ঘরের তালা খুলে ঘরে ঢোকা হ্যাকিং। ৫০ এবং ৬০ এর দশকে হ্যাকার বলা হত যারা রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি থেকে মেসেজ রিসিভ করতেন। বর্তমানে হ্যাকিং এর স্কুল রয়েছে যেখানে তালা খোলার পদ্ধতি থেকে শুরু করে সব ধরনের প্রতিরোধ ভাঙার পদ্ধতি শেখানো হয়।
আলোচনা ইন্টারনেট হ্যাকারদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাক। সম্প্রতি হ্যাকিং বিষয়ক ঘটনা প্রতিদিনের খবর। এনোনিমাস নামের সবচেয়ে পরিচিত হ্যাকারদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ইউরোপ এবং দক্ষিন আমেরিকার কয়েকটি দেশ থেকে। এদের মধ্যে একজন অতি পরিচিত সাবু নামে। আদালতের তথ্যে প্রমান পাওয়া গেছে তিনি এফবিআই এর চর হিসেবে কাজ করছেন এবং অন্য হাকারদের কোজ তিনিই দিয়েছেন। ফল হিসেবে অন্যান্য হ্যাকার এবং সরকার-আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলির অবস্থান একেবারে মুখোমুখি। প্রতিদিন হ্যাকাররা হামলা করছে বিভিন্ন সরকারী ওয়েবসাইটে।
তাদের বিরোধীতার কারন আসলে কি ?
কিছুদিন আগে আমেরিকান নতুন দুটি আইন তৈরীর চেষ্টা করেছিল সোপা এবং পিপা নামে। মুল কথা, পাইরেসি বন্ধ করা হবে এর মাধ্যমে। কেউ অবৈধ কিছু ডাউনলোড করলে তার বিচার করা হবে। এর পক্ষে হলিউড কারন তারা মনে করে তারা সবচেয়ে ভুক্তভোগি।
প্রযুক্তি কোম্পানীগুলি এর ভেতরের বিষয় বুঝতে সময় নেননি। এই আইন কার্যকর করার জন্য প্রতি মুহুর্তে খবরদারী করা হবে। কেউ ইন্টারনেট ব্যবহার করলে তার সমস্ত কাজের হিসেব জমা হবে আইএসপির কাছে, সেখান থেকে সরকারের হাতে। ফলে গুগল, ফেসবুকসহ সিলিকন ভ্যালী সরাসরি বিপক্ষে দাড়িয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ওয়েবসাইট উইকিপিডিয়া প্রতিবাদে একদিন সাইট বন্ধ রেখেছে। ফল হিসেবে দুটি আইন প্রনয়ন স্থগিত রাখা হয়েছে। একই সময়ে এসিটিএ নামে একই কাজের জন্য আরেক আইন নিয়ে চুক্তি হচ্ছে বিভিন্ন দেশের সরকারের সাথে। ব্যাখা করা প্রয়োজন নেই, মুল উদ্দেশ্য একই।
সাধারন মানুষ এখনও এতটা সোচ্চার হয়নি। কারন সম্ভবত অজ্ঞতা। সাধারন মানুষের জানার কথাও না আসলে এর মাধ্যমে কি হতে যাচ্ছে।
একজন ব্যক্তি সরকার, নেতা বা ক্ষমতাশীল কোন ব্যক্তির খারাপ কাজের সমালোচনা করতে চান, কোন বিষয়ে প্রতিবাদ করতে চান। তারপক্ষে রেডিও-টিভি-সংবাদপত্র ব্যবহারের সুযোগ নেই। এগুলির মালিকানা সরাসরি সরকারের হাতে অথবা সরকারের নিয়নাত্রনাধীন ব্যবসায়ীদের হাতে। অন্য কোনভাবে সরকারবিরোধী মত প্রকাশ করলে মামলা, জেল থেকে শুরু করে মৃত্যুও ঘটতে পারে। তারজন্য নিরাপদ একটি ব্যবস্থা ইন্টারনেট। মিসরের মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে আন্দোলন গড়ে তুলেছে এবং মোবারক সরকারের পতন ঘটিয়েছে।
এই আইন যদি বাস্তবে ব্যবহার করা হয় তাহলে সরকার আইএসপির কাছ থেকে প্রত্যেকের তথ্য সংগ্রহ করবে এবং তাদের জেলে ঢোকাবে। বর্তমানেও কোন কোন দেশে সেটা করা হয় যদিও আন্তর্জাতিকভাবে সেটা মানবাধিকার লংঘন। কারো ব্যক্তিগত বিষয় গোপন রাখা তার অধিকার। এই আইনে সেটা তুলে দেয়া হচ্ছে সরকারের হাতে।
হয়ত উল্লেখ করা প্রয়োজন নেই, সব দেশের সরকারই বিষয়টি পছন্দ করে। তাদের মুল উদ্দেশ্য সবাই তাদের নিয়ন্ত্রনে থাকুক। কোনভাবেই যেন চোখের আড়ালে কিছু না করে, সরকারের দোষত্রুটি আলোচনার বিষয় না হয়। বাংলাদেশের মত দরীদ্র দেশেও সেকারনে দ্রব্যমুল্য, কৃষি, শিক্ষা, চিকিতসা, কর্মসংস্থান এসবের চেয়ে সিসি-ক্যামেরা, আইডি ইত্যাদি বেশি আগ্রহের বিষয়।
এখানেই ভুমিকা নিয়েছে হ্যাকাররা। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশ-ভারত সিমান্তে নিয়মিত হত্যা বন্ধে কিছু করতে রাজি না, হ্যাকাররা প্রতিবাদ করেছে। কোন দেশেই এভাবে মানুষ হত্যা মেনে নেয়া যায় না। শুরুতে বাংলাদেশের হ্যাকাররা একাজ করেছে, তাতে সমর্থন দিয়েছে এনোনিমাস।
হ্যাকাররা বর্তমানে একধরনের প্রতিবাদকারী। আপনি রাজপথে নেমে প্রতিবাদ করতে পারেন। সেখানে দুএকজন মাথামোটা মানুষ ভাংচুর করবে, অন্যের ক্ষতি করবে। সরকার তাকে কারন হিসেবে ব্যবহার করে সাথেসাথে ব্যবস্থা নেবে, জেলে পুরবে। পুলিশ মনে করবে তাদের দায়িত্ব সাধারন মানুষের অর্থ ব্যয় করে সরকার রক্ষা করা। মুল আন্দোলন হারিয়ে যাবে।
সেতুলনায় হ্যাকাররা অনেক সচেতন। তাদের আক্রমন নির্দিষ্ট। তাদের কারনে অনেককে সমস্যায় পরতে হয় একথাও তারা জানে, তারপরও রাজপথের প্রতিবাদের চেয়ে একে বেশি উপযোগি মনে করে। অন্তত এরসাথে তাদের ব্যক্তিস্বার্থ জরিত না। তারা নিজের লাভের কারনে কাজ করছে না।
হ্যাকার বনাম সরকার এই যুদ্ধ সম্ভবত চলতে থাকবে। ধারনা করা যায় সাধারন মানুষ হ্যাকারদের পক্ষ নেবে।
অবশ্যই ক্রেডিট কার্ড চুরি করা হ্যাকারদের কথা বলা হচ্ছে না।
No comments:
Post a Comment