যদি পত্রপত্রিকার লেখা পড়েন কিংবা টিভির বক্তব্য শোনেন কিংবা যারা ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলেন তাদের বক্তব্য শোনেন আপনার মনে হবে বাংলাদেশ তরতর করে ডিজিটাল দেশে পরিনত হচ্ছে। সরকার সময়সীমা বেধে দিয়েছেন ২০২১ সন। এখনও ১০ বছর হাতে আছে। ততদিনে দেশ ডিজিটাল না হয়ে যায় না।
আর এরসাথে যদি বাস্তবতা মিলিয়ে দেখতে চান তাহলে খটকা লাগবে এটাই স্বাভাবিক। ১৫ কোটি মানুষের দেশে ইন্টারনেট ব্যবহার করে মোটামুটি ১০ লক্ষ মানুষ। শতকরা ১ এর বহু নিচে। বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে ওয়াইম্যাক্স (অনেকের ভাষায় ফোরজি, যদিও ফোরজি নামে আরেক ধরনের নেটওয়ার্ক চালু হয়েছে অনেক দেশে) চালু করা হয়েছে বছরদুয়েক হতে চলল। তাদের গর্ব তাদের গ্রাহক সংখ্যা ৫০ হাজার।
এই দুটিকে একসাথে করলে প্রশ্ন করা স্বাভাবিক, দেশ আসলে কতদিনে ডিজিটালে পরিনত হবে। আদৌ ডিজিটালে পরিনত হওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা। যদি প্রয়োজন থাকে তাহলে কিভাবে সেকাজ দ্রুত করা যায়।
ডিজিটাল হওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা একথার এককথার উত্তর, আছে। সরকারের হিসেবে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা আড়াই কোটি, বেসরকারী হিসেবে সাড়ে চার থেকে পাচ। এদের বড় অংশ শিক্ষিত। এদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা বর্তমান ব্যবস্থায় অসম্ভব। কয়েক কোটি মানুষকে অন্যদেশে কর্মসংস্থানের জন্য পাঠানোর চিন্তাও অবাস্তব। অথচ ডিজিটাল যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যবহার করে এদেরকে দেশে রেখেই কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয়া সম্ভব। এমনকি এজন্য কিছু করে দেয়াও প্রয়োজন নেই। যে বাধাগুলি আছে সেগুলি দুর করাই যথেষ্ট।
অনেকেই বলেন ইন্টারনেটের গতি বাড়ালে ডিজিটালে রুপান্তরের গতি বাড়বে। কথাটা আংশিক ঠিক। বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে বাকি বিশ্বের সাথে তুলনা করা যায় না। একদিকে বিপুল পরিমান অর্থ দিতে হয় অন্যদিকে আরো লাভের উদ্দেশ্যে আইএসপি গুলি তাদের ব্যান্ডউইডথ কমিয়ে রাখেন। বেশি সময় মানে বেশি টাকা এই নিয়মে। তারপরও, ইন্টারনেটের যে কাঠামো রয়েছে তাতেই বহুকাজ করা সম্ভব সামান্য কিছু অনিয়ম দুর করে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে সত্যিকারের বাধা হচ্ছে একে সত্যিকারের কাজে না লাগানো। কেউ ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পেলেই তাকে কাজে লাগাবে এমন ধরে নেয়ার কারন নেই। বরং তাকে দিক নির্দেশনা না দিলে সে বিপথে যাবে এটাই স্বাভাবিক। সেইসাথে মুল কাজে যদি বাধা সৃষ্টি করে রাখা হয়।
মানুষকে আগ্রহি করার প্রধান উপায় হচ্ছে সেখানে লাভের সুযোগ সৃষ্টি করা। আরো সরাসরি উল্লেখ করলে আর্থিক লাভের উপায় হিসেবে ব্যবহার করা। সবচেয়ে বড় বাধা সেখানেই। বাংলাদেশে অনলাইনে লেনদেন করা অবৈধ (বিশেষ কিছু ব্যক্তি বাদ দিয়ে)। কাজেই আপনি যদি লাভ করতে চান সেপথ বন্ধ।
অথচ ইন্টারনেটে লেনদেনের ব্যবস্থা চালু হলে কর্মসংস্থান কিভাবে হতে পারে একবার ভেবে দেখুন। আপনি একটা ওয়েবসাইট খুলে তাকে দোকান হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। কোন জিনিষ কিনে রাখার প্রয়োজন নেই। সেখানে ছবিসহ বর্ননা এবং দাম লেখা থাকবে। কেউ কিনলে সেটা বাজার থেকে সংগ্রহ করে পাঠিয়ে দেবেন। বর্তমান ব্যবস্থায় এটা সম্ভব। তাহলে গ্রাম কিংবা মফস্বল থেকে মানুষকে শহরে ছুটতে হয় না প্রয়োজনীয় জিনিষ কেনার জন্য। আর মাঝখান থেকে বহু মানুষ স্বল্প পুজিতে ব্যবসার সুযোগ পান। আর ক্রেতা তখন মফস্বল বা গ্রামে থেমে থাকবে না, সারা বিশ্বে যে কোন যায়গা থেকে যে কেউ ক্রেতা হতে পারে।
কেউ কেউ বলেন আগে ইন্টারনেট, তারপর ...
এটা নিজের স্বার্থ রক্ষা করা বক্তব্য। এবিষয়ে বিস্তারিত বর্ননায় না গিয়ে এটুকু বলতে পারি, ইন্টারনেটে কেনাবেচা একদিনে শুরু হয়না। এরসাথে সংস্কৃতি জড়িত। বলাহয় ইউরোপ আমেরিকায় মানুষ গরু কেনে কথার অর্থ তারা একটুকরো কাগজ কেনে যেকানে লেখা রয়েছে গরুর বর্ননা, মাপ, ওজন এবং সুস্থতার সার্টিফিকেট। বাংলাদেশে মানুষ গরু কিনতে হাটে যায়, টিপে-টুপে দেখে, তারপরও সেই গরু সুস্থ এমন নিষ্চয়তা নেই। অন্য জিনিষ কেনার ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। জিনিষটা আসল নাকি ভেজাল নাকি নকল সেই নিশ্চয়তা দেয়া কঠিন। অন্তত এই বিশ্বাস গড়ে তুলতেই বহু সময় প্রয়োজন।
যারা ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেকান তারা ক্রমাগত বলে চলেছেন একেবারে কৃষক পর্যায়ে ইন্টারনেট পৌছে দেয়া হবে। কৃষক ইন্টারনেট থেকে পরামর্শ পাবেন। শুনতে খারাপ লাগলেও বলতে হচ্ছে, একজন কৃষক কৃষিকাজ শেখে তার পুর্বপুরুষের কাছে। যেভাবে মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে কৃষিকাজ করে আসছে। এবং সেটাই সবচেয়ে ভাল পদ্ধতি। তাকে কৃষিকাজ শেখানোর জন্য ইন্টারনেটে পরামর্শকেন্দ্র তৈরী করা প্রয়োজন নেই। আর বাংলায় ফেসবুক তৈরীর বিষয়টিও তত গুরুত্বপুর্ন বিষয় না।
ইন্টারনেট প্রসার অথবা ডিজিটাল বাংলাদেশ যাই বলুন না কেন, সেটা সত্যিকার প্রয়োজন শিক্ষিত মানুষের। যারা একে ব্যবহার করে শিক্ষা বা আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেন। ইন্টারনেট থেকে অর্থ উপার্জনের বিষয়ে মানুষ প্রশ্ন করতে শুরু করেছে। সহযোগিতা না করলেও বাকিটা তারা নিজেরাই শিখে নিতে পারবে। তাদের যা প্রয়োজন তা হচ্ছে অর্থ লেনদেনের ব্যবস্থা চালূ করা। একদিকে বলা হবে অমুক নেতা শতকোটি টাকা পাচার করেছে অন্যদিকে একজন কাজ করে ৫০০ ডলার পেতে চায় তাকে বাধা দেয়া হবে এই ব্যবস্থায় দেশ ডিজিটাল হয় না।
মনিটরিং ব্যবস্থা চালু হলেই এটা করা হবে, এধরনের বক্তব্য মানুষ অনেক শুনেছে। ৫০০ ডলার কিংবা হাজার ডলার যে নিজের যোগ্যতায় আয় করতে চায় তার গলাটিপে ধরা প্রয়োজন নেই। আপাতত ওই মনিটরিং ছাড়াই সেটা চালু করুন। এটুকু আস্বস্ত করতে পারি, এভাবে লক্ষ ডলার কিংবা কোটি ডলার লেনদেন করা যায় না। সেটা করা যায় ব্যাংকের মাধ্যমে, এবং ব্যাংক সেটা জেনেশুনে ইচ্ছে করেই করে। ব্যাংকগুলোর টার্গেট ক্লায়েন্ট তারাই। যে কারনে একজন কম টাকার একাউন্ট করতে গেলে পাসপোর্ট, বন্দুকের লাইসেন্স, জন্মমৃত্যুর সার্টিফিকেট সবকিছু নিতে হয়, তার ওপর সাথে করে সাক্ষী নিয়ে যেতে হয়। যেন তারা নিজের টাকা রাখতে যাননি, গেছেন ব্যাংকের পৈত্রিক সম্পত্তিতে ভাগ বসাতে।
পড়াশোনা শেষ করে একজন ব্যক্তি নিশ্চিত বেকারত্বের পথে যাবেন নাকি নিজের কর্মসংস্থানের পথ বের করবেন সেটা নির্ভর করে সমাজ তাকে কতটা সহায়তা দেয় তার ওপর। ইন্টারনেট ব্যবহার করে কিছু করতে তার প্রয়োজন সার্ভার ভাড়া করা, সফটঅয়্যার টুল কেনা সহ অন্যান্য দিকে বিনিয়োগ করা। অনেকেই নিজের টাকায় এসব করতে রাজী। এসব করতে প্রয়োজন হয় অনলাইনে লেনদেন। সরকার বলে দিচ্ছেন ক্রেডিট কার্ড শুধুমাত্র শীর্ষ ব্যবসায়ী এবং স্মাগলারদের জন্য, ব্যাংকও তাদের জন্য। ইদানিং গর্ব করে বলা হচ্ছে সীমিত আকারে অর্থ লেনদেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে, তবে সেজন্য অমুক বিশেষজ্ঞের সার্টিফিকেট নিতে হবে। নাগরিককে যেমন নাগরিকত্ব সার্টিফিকেটের জন্য এলাকার সবচেয়ে ধান্দাবাজ ওয়ার্ড কমিশনারের কাছে যেতে হয়। এমন প্যাচালো মনোভাব নিয়ে দেশ ডিজিটাল করা যায় না। ইদানিং আউটসোসিঙ কোম্পানী ভারতের নাগরিকদের তাদের স্থানীয় ব্যাংক একাউন্টে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা চালু করেছে, অথচ বাংলাদেশের নাম পে-পলের লিষ্টে নেই।
দেশকে ডিজিটাল করুন (অথবা এনালগই রাখুন), অর্থনৈতিক উন্নতির পথে বড় বাধা অনলাইন এবং অফলাইন দুদিকেই অর্থ লেনদেনের পদ্ধতিতে সমস্যা। এগুলি বর্তমানে কালোটাকার মালিকদের হাতে। এগুলি সকলের ব্যবহার উপযোগি করলে মানুষ নিজেই কর্মসংস্থানের পথ খুজে নিতে পারে।
No comments:
Post a Comment