Wednesday, January 4, 2012

অনলাইন ব্যবসা, ফ্রিল্যান্সিং এবং বাংলাদেশ

কদিন আগে ই-এশিয়া সন্মেলন হয়ে গেল ঢাকায় যেখানে এসেছিলেন শীর্ষস্থানীয় ফ্রিল্যান্সিং প্রতিস্ঠান ওডেস্ক এর ভাইস প্রেসিডেন্ট। একটি কথা প্রচার করা হয়েছে, ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ফ্রিল্যান্সার এর শহরের তালিকায় ৩য়।  একে আপনি যে অর্থে দেখতে চান দেখতে পারেন। বলতে পারেন আমাদের ঢাকার (কিংবা দেশের) গর্ব করার মত বিষয়, সমালোচক হলে ভিন্নভাবে দেখতে পারেন। সেভাবে দেখার কারনকে অস্বিকার করার উপায় নেই। আপনি যখন ওডেস্ক থেকে সরাসরি টাকা পাওয়ার পদ্ধতি জানেন না। তাদের টাকা দেয়ার পদ্ধতি ক্রেডিটকার্ড, পেপল এবং অয়্যার ট্রান্সফার। অনেকেই যেখানে মানিবুকারস (বাংলাদেশে ব্যবহার করা যায়) কিংবা ব্যাংক চেক দেয়ার ব্যবস্থা রেখেছেন (যেমন স্ক্রিপ্টল্যান্স কিংবা গুরু)।
প্রথমে ঢাকার তৃতীয় স্থান অধিকার করার বিষয়টি একবার দেখে নেয়া যাক। পশ্চিমা দেশগুলিতে একজন ছাত্র পড়াশোনার জন্য ব্যাংক থেকে সহজে লোন পান, পড়াশোনা শেষ করে চাকরী পান এবং সেই লোন শোধ করেন। যারা অভিভাবকের কাছে অর্থ নেন তারাও সেই অর্থের হিসেব রাখেন এবং কর্মজীবনে তাদের প্রথম দায়িত্ব সেই ঋন পরিশোধ করা। তাদের মানষিকতা তৈরী হয় দেয়া-নেয়ার ওপর ভিত্তি করে। যেকারনে ২০ ডলারের কাজ করার পর ৩০ ডলার দিলে প্রশ্ন করেন, অতিরিক্ত টাকা কেন নেব। বাংলাদেশের প্রেক্ষিত ভিন্ন। একজন ছাত্র ধরেই নেন তার খরচ দেয়া পরিবারের দায়িত্ব। পড়াশোনা তো বটেই বন্ধুবান্ধবের সাথে যে খরচ হয় সেটাও। সেকারনে একধরনের পরনির্ভরশীল মনোভাব তৈরী হয়। আরো স্পষ্ট করে বললে, বাংলাদেশের মানুষ সহজেই অন্যের কাছে হাত পাতেন। তাকে আরো জোরালো করে কাজের সুযোগ না থাকা। বাংলাদেশে ছাত্রদের জন্য পার্টটাইম বা বিশেষ সময়ে কাজের কোন বিষয় নেই, কেউ সেটা নিয়ে মাথা ঘামানো প্রয়োজনবোধ করেন না। যদিও যারা বিদেশে যান তারা একথা মাথায় রেখেই যান, পড়াশোনার সাথে কাজ করে অর্থ উপার্জন করবেন।
এরসাথে যদি যোগ করা হয় পড়াশোনা শেষে চাকরী না পাওয়ার নিশ্চয়তা তাহলে ওডেস্ক এর সদস্য বেশি হওয়া কি অস্বাভাবিক ? যেদেশে স্থানীয়ভাবে কাজের সুযোগ নেই, চাকরীর সুযোগ নেই সেদেশ থেকে ভিন্নভাবে কিছু করার চেষ্টা করবেন এটাই তো স্বাভাবিক। বরং এই সংখ্যার কতজন সফলভাবে কাজ করছেন, কিভাবে করছেন সেটা জানালে অন্যরা উপকৃত হত।
মানুষ আশা করে, স্বপ্ন দেখে, সেই স্বপ্ন নিয়ে বেচে থাকে। যদি স্বপ্ন দেখতে পারেন বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থেই ডিজিটাল হয়েছে তাহলে কি হতে পারে সেধরনের কিছু বক্তব্য এখানে তুলে ধরা হচ্ছে।
উন্নত দেশগুলিতে মানুষ কেনাকাটার জন্য দোকানে যাওয়া ক্রমেই কমাচ্ছে। একদিকে সময় শাস্রয়, অন্যদিকে কেনাকাটা সহজ এই দুকারনে কেনাকাটা করছে ইন্টারনেটে। কাজটি খুবই সহজ। কম্পিউটারের সামনে বসে (এমনকি স্মার্টফোন ব্যবহার করেও) কি কিনবেন ঠিক করুন, সেখানে ক্লিক করে কিনে ফেলুন, টাকা দিন সেখান থেকেই। বিক্রেতা আপনার বাড়িতে জিনিষ পৌছে দেবে।
আপনি হয়ত ব্যবসা করতে চান। এজন্য অফিস/দোকান নিতে বিপুল পরিমান বিনিয়োগের বিষয় সামনে চলে আসে। এরপর পন্য কেনা। অনেকের পক্ষেই সেটা সম্ভব না। আর দোকান দিলেও আপনি বড়জোর আপনার এলাকার ক্রেতা পাচ্ছেন। দেশের অন্য জেলার ক্রেতার কাছে বিক্রির জন্য তাকে দোকান পর্যন্ত আনার ব্যবস্থা করতে হবে।
এই ব্যবসা যদি অনলাইনে করতে চান তাহলে কাজটি খুব সহজ। একজন ওয়েব ডেভেলপার দিয়ে ওয়েবসাইট তৈরী করে নিন, কি জিনিষ কত দামে বিক্রি করবেন ছবি-বর্ননা সহ লিখে রাখুন। যিনি কিনবেন তিনি অনলাইনে টাকা দেবেন আপনি তারকাছে জিনিষটি পৌছে দেবেন। আপনাকে দোকান দেয়ার প্রয়োজন নেই, নিজের ঘরে একটি চেয়ার-টেবিলই যথেষ্ট। পন্য কিনে গুদামে রাখারও প্রয়োজন নেই, আগে বিক্রি করে তারপর কিনে পাঠাতে পারেন। আর ক্রেতার সুবিধে হচ্ছে তাকে দোকানে দোকানে ঘুরতে হচ্ছে না। এমনকি গ্রাম থেকে শহরে যাওয়া প্রয়োজন হচ্ছে না। সেও জিনিষ পাচ্ছে ঘরে বসেই।
সমস্যা খুব সামান্য। ইন্টারনেটের গতি এবং অনলাইনে অর্থ লেনদেন সহজ করা। বাংলাদেশে অনলাইনের গতি ঠিক করে আইএসপিগুলো। যেভাবে তাদের লাভ হয় সেভাবে হিসেব করে। এটা নিয়ন্ত্রন করা খুব সহজ যদি সরকার অর্থের লোভ সম্বরন করতে পারে। বাংলাদেশে বর্তমানে যে প্রযুক্তি চালু আছে সেটা ব্যবহার করেই সম্ভব।
বাকি থাকে অর্থ লেনদেনের ব্যবস্থা। এধরনের কেনাকাটার জন্য সবচেয়ে উপযোগি পেপল। বিনামুল্যে সদস্য হোন, টাকা পাঠান বা গ্রহন করুন। যে কোন কারনেই হোক বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ এটা ব্যবহারের সুযোগ দিতে রাজী নন। তাদের বক্তব্য, বাংলাদেশের সবাই  ক্রিমিনাল। সুযোগ দিলে দেশের সব টাকা বিদেশে পাচার করে দেবে। মনিটরিং এর ব্যবস্থা না করে এটা চালু করা যাবে না। মনিটরিং নামের সেই ফাস কিভাবে লাগানো হবে, কতদিনে লাগানো হবে কেউ জানে না। যেকোন পরিকল্পনার শুরুতেই ঠিক করে নেয়া হয় কাজটি কতদিনে শেষ হবে, এক্ষেত্রে সময় সীমাহীন।
আরেকটি সমস্যা ব্যাংক ব্যাবস্থা। বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাংক চলে মহাজনি ব্যবসার নিয়মে। যেন তারা আপনার টাকায় ব্যবসা করছে না, আপনি তাদের কাছে টাকা চাইতে গেছেন। যতরকম হয়রারি করা সম্ভব সব করতে রাজী। আইএসপিগুলোর মত ব্যাংকের কাছেও সরকার অসহায়। আইএসপিগুলো ব্যান্ডউইডথ ব্যবহার করছে না, ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম মানছে না, সরকারের অকপট বক্তব্য। এই বক্তব্য দেয়ার বাইরে তারা কিছু করতে রাজী নন।
শুধুমাত্র এই সমস্যাটুকু দুর করলে সমাজে রীতিমত বিপ্লব ঘটে যেতে পারে। একদিকে অনলাইন ব্যবসার সুযোগ পেতে পারে হাজার হাজার কিংবা লক্ষ মানুষ, অন্যদিকে তাদের ওয়েবসাইট তৈরী, দেখাশোনা, গ্রাফিক ডিজাইন, বিজ্ঞাপন, প্রচার, পন্য তৈরী, সরবরাহ এসবের মাধ্যমে কাজের সুযোগ পেতে পারেন বহু লক্ষ মানুষ। বর্তমানের মত সবাইকে ওডেস্কে ভিড় জমাতে হবে না। স্থানীয়ভাবে কাজ করে যারা আন্তর্জাতিক কাজের দক্ষতা অর্জন করবেন তারা সহজে কাজ পাবেন বাইরে থেকে। সেটা না করলে যে আউটসোর্সিং থেকে দেশ ধনী হওয়ার কথা বলা হচ্ছে সেটা ডিজিটাল বাংলাদেশের মতই হাস্যকর শব্দে পরিনত হবে।
তারপরও এটা হচ্ছে না কেন ?
কে জানে! হয়ত ওডেস্কে ভিড় বাড়ানোই বেশি লাভজনক। দেশ নিয়ে বেশ গর্ব করা যায়।

1 comment: